Sunday, July 28, 2013

ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং ক্ষুধা দর্শন

"তোমাদের কি মন খারাপ ?"

"ঠিক মন খারাপ না, খুব ক্ষিদে লেগেছে।"

"ও আচ্ছা। তোমার সাথে ওটা কে?"

"আমার ছোট ভাই।"

"ও, তা তোমার ছোট ভাইটা খালি গায়ে রাস্তায় শুয়ে আছে কেন?"

"জামা পাবে কোথায় ? তাছাড়া সকাল থেকে তো না খেয়ে আছে। তোমার কাছে কিছু খাবার হবে?"

"তোমাদের তো দেখি খালি খাই খাই স্বভাব।"

"বললাম না খুব ক্ষিদে লেগেছে। আচ্ছা সব মানুষই কি ক্ষিদেয় কষ্ট পায় ?"

"না তা হবে কেন? অনেকের বাড়িতে প্রচুর খাবার থাকে। এত খাবার যে তারা খেয়েও শেষ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ফেলে দিতে হয়।"

"খাবার ফেলে দিতে হয়?"

"হ্যাঁ, অনেক খাবার বেঁচে যায়, তখন ফেলে দিতে হয়।"

"ফেলে না দিয়ে বরং আমাদের তো দিয়ে দিতে পারে।"

“দিতে চায় না আর কি।আর তাছাড়া তোমাদের খাবার দেয়াও তো একটা ঝামেলার কাজ। এত ঝামেলা কে করতে চায় বল?”

“আচ্ছা তাদের বাড়িতে কত খাবার থাকে ?”

“অনেক অনেক খাবার থাকে। বলে বোঝানো তো মুশকিল।“

“ওদের বাড়িতে কি যত খুশি ভাত খাওয়া যায়?”

“অবশ্যই যায়।“

“বেশি ভাত খেয়ে ফেললে কেউ কিছু বলে না?”

“কেউ কিচ্ছু বলে না। যে কেউ যত খুশি খেতে পারে।“

“আচ্ছা ভাতের সাথে কি ডালও থাকে?”

“শুধু ডাল না, আরও অনেক কিছুই থাকে।“

“আচ্ছা আমি আর আমার ছোট ভাই কি ওদের বাড়িতে গিয়ে একদিন ভাত খেয়ে আসতে পারি?”

“না তা হবে না। দারোয়ান তোমাদের ঢুকতেই দেবে না।“

“এত ভাত, তাহলে আমাদের কিছুটা দিলে অসুবিধা কী?”

“কোন অসুবিধা নেই। দিতে চায় না, তাই দেবে না। প্রশ্নটা সুবিধা অসুবিধার নয়, ইচ্ছা অনিচ্ছার। তোমার কি খুব বেশি ক্ষিদে লেগেছে ?”

“হু। আচ্ছা আমার ছোট ভাইটার কথা বললে কি কিছু ভাত দেবে? ওর বয়স তো খুব কম। মাত্র তিন বছর। এখনও ঠিকমত ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না।“

“কারো কথা বলেই কোন লাভ নেই। এক কাজ কর, তোমার ভাইটাকে বেশি করে পানি খাইয়ে দাও। এখন থেকেই ক্ষিদে সহ্য করার অভ্যেস করুক।“

“আচ্ছা ওদের বাড়িতে এত খাবার কেন?”

“এত খুব জটিল প্রশ্ন। তবে সহজ কথায় ধরে নিতে পার এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। অবশ্য কেউ কেউ সমাজ ব্যবস্থাকেও দায়ী করে।“

“ঈশ্বর চান যে আমরা না খেয়ে থাকি?”

“সম্ভবত তাই।“

“তোমাদের ঈশ্বর এমন কেন?”

“ঈশ্বর তার ইচ্ছেমত চলেন। তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করেন না। কারন তার শক্তি সবচেয়ে বেশি।“

"শক্তি বেশি হলে কি সবাই স্বেচ্ছাচারী হয়?"

"তা তো বটেই। শক্তির প্রকাশ ঘটে স্বেচ্ছাচারীতায়।"

"ঈশ্বরের এত শক্তি, তিনি আমাদের খাবার দিতে পারেন না ?"

"চাইলে অবশ্যই পারেন, কিন্তু তিনি দিতে চান না।"

“আমার ছোট ভাইটা অনেকক্ষণ কোন কথা বলছে না। বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকলে কি মানুষ মরে যায়?”

"ভয় নেই। তোমার ছোট ভাই মরবে না। ফুটপাতে যারা জন্মায় তাদের জান খুব শক্ত হয়। আর তাছাড়া মরলেও খুব বেশি কিছু যায় আসে না । মৃত্যু খুব সামান্য ব্যাপার। ফুটপাতে জন্মালে কষ্ট সহ্য করতে হয়। কষ্ট সহ্য করতে শেখ। ক্ষিদের কষ্টটাকে উপভোগ করতে শেখ। Have a happy hunger."

Thursday, July 25, 2013

স্যার, আমাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবে কে ?

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ২২ তারিখ। আমি দাঁড়িয়ে আছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। সি বিচে প্রচন্ড ভীড়। মোটামুটি তিল ধারনের জায়গা নেই।

সি বিচে স্পিডবোটে চড়ার ব্যবস্থা আছে। স্পিডবোট বিচ থেকে খুব বেশি দূর যায় না। সি বিচের খুব কাছাকাছি একটা চক্কর দিয়ে চলে আসে। এই এক চক্করেই মানুষ বিপুল আনন্দ লাভ করে।


আমার প্রচন্ড আগ্রহ স্পিড বোটে ওঠার। ২০০৫ সালে প্রথমবারের মত কক্সবাজার গিয়ে খুব বিপদ জনক ভাবে স্পিডবোটে চড়েছিলাম। সে গল্প আরেক সময় বলা যাবে।


স্পিডবোটওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম – “ কত লাগবে?”


স্পিডবোটওয়ালা জন প্রতি পঞ্চাশ টাকা করে চাচ্ছে। আমার মুখ শুকিয়ে গেল । হাতে টাকা পয়সা নেই। পঞ্চাশ টাকা করে স্পিডবোটে ওঠা সম্ভব না।


আমি দরদাম শুরু করলাম –“দশ টাকা করে দিলে হবে ?”


স্পিডবোটওয়ালা মধুর ভঙ্গীতে হাসল। তার হাসিতে অপমান ঝরে পড়ছে। দরিদ্র মানুষদের এ ধরনের অপমান সহ্য করার অভ্যাস থাকতে হয়। 


আমার পাশে সত্তর বছর বয়সের এক বৃদ্ধ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন । ঘটনার এই পর্যায়ে তিনি আমার হাতে একশ টাকার দুটো নোট গুঁজে দিলেন স্পিডবোটে ওঠার জন্য।


প্রিয় বন্ধুগণ, এই বৃদ্ধের নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ – বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের অতি প্রিয় শিক্ষক।আজ তার জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে লিখব বলেই এত ভূমিকা করতে হল।


মূল ঘটনায় ফিরে আসি। স্পিডবোট ভাড়া নেয়া হয়েছে। বোটে আমরা চারজন – আমি, স্যার, রাজীব সরকার এবং নার্গিস। (আমি স্মৃতি থেকে লিখছি –তাই বোটে মামুন, মুন্নি অথবা হাশিম ভাই এদের কেউ উঠেছিলেন কি না ঠিক মত মনে করতে পারছি না।)


স্পিডবোট চলছে । বাকি সবাই বসে আছে। আমি একা বোটের সামনের অংশে দাঁড়িয়ে আছি এবং ক্রমাগত চেঁচাচ্ছি। বোটের বিকট শব্দে আমার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে না। স্পিডবোটের প্রসঙ্গ এখানেই শেষ করা যাক।


আমার নিজের জীবনে ভ্রমন অভিজ্ঞতা খুব বেশি না। ২০০৮ সালের এই বান্দরবান কক্সবাজার ভ্রমণ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণগুলোর একটা। 


এই ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে বান্দরবন থেকে কক্সবাজার বাসযাত্রা। আমি স্যারের পাশে বসেছি। আমাদের ঠিক পেছনের সিটে বসেছে মুন্নি এবং হাশিম ভাই। পাহাড়ী পথ দিয়ে বাস যাচ্ছে। পথের দৃশ্য অতি মনোরম।আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি স্যারকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছি। হাশিম ভাই পরে অভিযোগ করেছেন আমাদের বকবকানিতে তার কান ঝালাপালা হয়ে যাবার যোগাড়।


কয়েক ঘন্টার এই বাসযাত্রায় স্যারের সাথে আমার কথোপকথনের একটা বর্ণনা এখানে দেয়া যেতে পারে।

পাঁচ বছর আগের কথা। কথাগুলো হুবহু আমার মনে নেই। কিন্তু সেদিন তিনি যা বলেছিলেন তার মূল বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকমই ।

আমি বললাম, স্যার, অনেকেই বলে আপনি সবসময় ক্ষমতাবান মানুষদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন এবং কখনোই এদের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না।তাছাড়া আপনি কেন্দ্র চালান বিদেশি সাহায্যের টাকায়।


স্যার বললেন, কথাটা ঠিক। কিন্তু এটা না করলে আমি এই প্রতিষ্ঠান চালাতে পারতাম না।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চালানোর জন্য এর কোন বিকল্প ছিল না।


আমি - আপনি নিজে তো মিডিয়ার সৃষ্টি ।


[স্যার এক সময় বিটিভিতে উপস্থাপনা করতেন। সেই প্রেক্ষিতেই প্রশ্নটা করা। আমার এই প্রশ্ন শুনে স্যার মোটামুটি খেপে উঠলেন এবং আমি বুঝলাম অভিযোগটা আংশিক হলেও ঠিক।]


এর জবাবে তিনি যা বলেছিলেন তার মূল বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকম – “মিডিয়ার সামনে প্রতিদিন শত শত লোক এসে দাঁড়ায়। মানুষ কিন্তু এদের সবাইকে গ্রহণ করে না। দর্শকরা তাকেই মনের মধ্যে ঠাঁই দেয় যে দর্শকদেরকে কিছু দিতে পারে। টেলিভিশন ছেড়ে এসে আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলেছি, সমস্ত জাতির শিক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমি যদি টেলিভিশনে থাকতাম, তাহলে আজকে টেলিভিশনের যে অধঃপতন ঘটেছে আমি তা ঘটতে দিতাম না। আমি এই অধঃপতন থামিয়ে দিতাম।”


পরে আমার মনে হয়েছে, এই অভিযোগটার মধ্যে কিছুটা গলদ আছে। মিডিয়া আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে সৃষ্টি করেনি। মিডিয়া কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। মিডিয়া তাকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে মাত্র। 


আমি প্রশ্ন করলাম –“মানুষ অভিযোগ করে যে আপনি বিদেশী সাহায্যের টাকায় প্রকাশনা ব্যবসা চালান, কম দামে বই বিক্রি করেন। এতে আমাদের প্রকাশকরা মার খায়। আমাদের প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতি হয়।”


স্যার বললেন – “এটা একেবারেই মিথ্যে কথা। এদেশের প্রকাশকরা ডাকাতের মত লাভ করে বলে বইয়ের দাম বেশি হয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে আমরা যে বইগুলো প্রকাশ করি সেগুলোতে আমরা খুব কম লাভ করি।তাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইয়ের দাম কম হয়। আমাদের প্রকাশনার অংশটা শুরু হয়েছিল একটু অন্যভাবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য এক একটা বই একশ দুইশ কপি করে কিনতে হয়। তখন দেখলাম দুইশ বই কিনতে যে টাকা লাগে তাই দিয়ে বই প্রকাশ করে ফেলা যায়। এভাবেই শুরু হল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই প্রকাশনা।”


[যারা বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের প্রকাশনা বিভাগ সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানেন না, তাদের জন্য বলছি – বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের কিছু বই প্রকাশ করে। বইগুলোর দাম কম, ছাপার মান বেশ ভাল। ]


আমি জিজ্ঞেস করলাম – “স্যার অনেকেই অভিযোগ করে বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে যাদের অবদান ছিল, যারা পরিশ্রম করেছে তাদের আপনি মূল্যায়ন করেননি।"


এর জবাবে তিনি কি বলেছিলেন সেটা সবার সামনে বলে দেয়াটা ঠিক হবে না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটিও তার জীবনে সব কথা সঠিক বলেন না।


লেখাটা এখানে শেষ করা উচিত। শেষ করি অন্য একটা ঘটনা দিয়ে।


এই ঘটনার প্রায় এক দেড় বছর আগের কথা। স্যারের সাথে নারায়নগঞ্জ গেছি। সেখানে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি আলোকিত মানুষ তৈরীর কথা বলেন, মানুষকে আশাবাদের কথা শোনান, অথচ বিশ্বাসাহিত্য কেন্দ্রে আপনার কর্মচারীরা এত হতাশ কেন ?


স্যার বলেছিলেন, আমার কর্মচারীরা হতাশ কারণ এদের একজনও বই পড়ে না। এদের মধ্যে একমাত্র ইশতিয়াক বোধহয় কিছু পড়ে, আর কেউ বই পড়ে না। এরা আশাবাদী হবে কি করে ?


এরপর আমার প্রশ্ন করা উচিত ছিল, আপনি সারা দেশের ছেলেমেয়েদের বই পড়তে বলেন, নিজের কর্মচারীদের বই পড়াতে পারলেন না কেন ? প্রশ্নটা করা হয়নি। এরকম অসংখ্য প্রশ্ন আমরা বুকের মধ্যে চেপে রাখি।


স্যার চিরকাল থাকবেন না। কেউই থাকে না। আমাদের প্রশ্নগুলো কিন্তু তখনও শেষ হবে না। আমরা প্রশ্ন করব কাকে ? 


তবুও তাঁর জন্মদিনে আমারা প্রত্যাশা করি - আমাদের প্রশ্ন আর অভিযোগের জবাব দেবার জন্য তিনি আরো অনেকদিন বেঁচে থাকবেন। 


স্যারের জন্মদিনে অনেক অনেক শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা।

Thursday, April 25, 2013

আনিসুল হকের কাছে খোলা চিঠি

প্রিয় আনিসুল হক,

আজকের প্রথম আলোতে দুর্নীতি নিয়ে আপনার একটি লেখা ছাপা হয়েছে । এই লেখায় আপনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন - মানুষের কত টাকা লাগে ? মানুষ কেন দুর্নীতি করে ? এই প্রশ্ন দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং আমি নিশ্চিত যে এই ধরনের প্রশ্ন আগেও তোলা হয়েছে । এই বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু ধারনা আছে । আমি নিতান্তই সামান্য মানুষ । আমার বিশ্লেষণ, সরল বিশ্লেষণ । তবু আপনার লেখার প্রেক্ষিতে আমার ধারনাগুলো উপস্থাপন করছি। 


সাত আট বছর আগে, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের শ্রেনী বিন্যাস ছিল । একদম সহজ ভাষায় এই বিন্যাস ধনী ও গরীবের। আমার সহপাঠীদের একটি অংশ এসেছিলো বিত্তবান পরিবার থেকে। এরা ঢাকা শহরে স্থায়ী বাসিন্দা । ভার্সিটিতে আসত গাড়িতে চড়ে । হুটহাট করে ফাস্টফুডে চলে যেত, রাশি রাশি টাকা খরচ করত। হাতে থকত দামী মোবাইল ফোন। বোঝা যেত, টাকা খরচের জন্য এদের হিসেব করতে হয় না। 


এর বিপরীত চিত্রটি কিন্তু খুব বেদনাদায়ক। ছাত্রছাত্রীদের আরেকটি অংশটি আসত গ্রাম বা মফস্বল থেকে। এরা থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। দুপুর বেলা হলের ক্যান্টিনে ছয় টাকা দিয়ে ডাল - ভাত খেত। মাসের খরচ জোগাড় করত টিউশনি করে । এমনকি কেউ কেউ টিউশানি করে বাড়িতে টাকা পাঠাত। মাসের শেষের দিকে গিয়ে এদের খাওয়ার পয়সাই থাকত না, বিলাসী জীবনের তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। 


আমার বিশ্বাস, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই চিত্রটির সাথে আপনি নিজেও পরিচিত এবং আশা করি আমার বক্তব্যের সাথে আপনি দ্বিমত পোষণ করবেন না।


এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক । ছাত্র ছাত্রীদের এই দরিদ্র অংশটির একটি সাধারন স্বপ্ন থাকে -বিসিএস বা সরকারী চাকরী। এই সব দরিদ্র ছাত্র ছাত্রীরা জানে যে সৎ থাকলে বিত্ত বৈভবের যে সমৃদ্ধ জীবন, তা তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। সৎ থাকলে তাদেরকে আজীবন হয় মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত হয়ে কাটিয়ে দিতে হবে। সৎ থেকে কোন বিলাসী জীবন ছুঁয়ে দেখার উপায় এদেশে নেই। হিসেবটা খুব সহজ - হয় চুরি করে বড়লোক হও অথবা দরিদ্র থাক। আশেপাশের ভোগ বিলাসের জীবন ফেলে রেখে চব্বিশ বছরের কোন যুবক দরিদ্র সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতে পারে না । চুরি করা অন্যায় এ কথা সে জানে। কিন্তু সে এও জানে যে ভাল থাকতে হলে, ঢাকা শহরে গাড়ি আর ফ্ল্যাট থাকতে হলে, ঘরে এসি লাগাতে হলে, দামী একটা ল্যাপটপ কিনতে হলে, ফাস্টফুডের দোকানে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হলে তাকে খারাপ হতে হবে। 


বলার কিছু নেই । আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠি সমাজের ধনীদের পাশাপাশি অবস্থান করে। ধনীদের সমৃদ্ধ, উন্নত জীবন এরা খুব কাছ থেকে দেখে। বোঝে যে এই বিলাসী জীবন তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ধনীদের এই ঝলমলে জীবন ছুঁয়ে দেখতে হলে তাদেরকে খারাপ হতে হবে। আশেপাশে হাজারটা বিলাসী পণ্যের হাতছানি - দামী মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, পাজেরো গাড়ি, আলো ঝলমলে ফাস্টফুড শপ । সব কিছু তৈরী, প্রয়োজন শুধু টাকা । সুতরাং দুর্নীতি ছাড়া উপায় কি ? এই সমৃদ্ধ, বিলাসী জীবনের জন্য এক জন অনার্স পড়ুয়া তরুন যখন কাস্টমস অফিসার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন আমরা তাকে কি বলে বাধা দেব ?


এই দরিদ্র ছাত্রছাত্রীরা জানে নৈতিকতার বুলি দিয়ে ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া যায় না, পিজা হাটে গিয়ে হাজার টাকা বিল দেয়া যায় না। এই নৈতিকতা বছরের পর বছর তাদেরকে দারিদ্র্য ছাড়া যার কিছু দিতে পারেনি। নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন হচ্ছে পশুর জীবন। এই পশু জীবন থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় দুর্নীতি। সুতরাং হাতের কাছে কোটি কোটি টাকা রেখে সে কতদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।


আপনি একটু খোঁজ করলেই দেখতে পাবেন আমাদের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের বেশিরভাগই এসেছে কোন নিম্ন -মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। বছরের পর পর দ্রারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করার পর তারা পেয়েছে টাকার খনির সন্ধান। এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে কেন ? আমাদের বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতাদের জন্যও ঐ একই কথাই প্রযোজ্য। আসলে আমাদের দেশের শতকরা আশি ভাগ মানুষের জন্যই এই কথা সত্যি। এরা জানে দারিদ্র্য একটি দুর্বিষহ ব্যাপার । 


আমার এই বক্তব্য কিছুটা একপেশে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে আমি দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গাইবার চেষ্ট করছি । প্রকৃতপক্ষে, আমি এই সমস্যাটির গভীরে যাবার চেষ্টা করেছি এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে এই সমস্যাটির সাথে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছি। 


এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য আশা করছি। ধন্যবাদ।


শুভেচ্ছান্তে-

প্রবালাহমেদ

Monday, May 9, 2011

ছুরি হাতে প্রতিটি সন্ত্রাসী এবং প্রতিটি ঊশৃঙ্খল তরুনী একজন বিপ্লবী

কথাটা একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু আমার তাই মনে হয়।

অস্ত্রের মুখে অন্যের টাকা যে কেড়ে নেয় তাকে সন্ত্রাসী বলা হয়। কাজটা সরল দৃষ্টিতে অন্যায়। কিন্তু সরলতা সব সময় সত্য নয়। অতি সরলতা অনেক সময়ই বিভ্রান্ত করে।

যাদের টাকা পয়সা আছে, খেয়ে পড়ে ভাল থাকে তারা সাধারনত ঝামেলায় যেতে চায় না। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে ভালবাসে। এরা অনেক সময়ই বুঝে উঠতে পারে না মানুষ কেন সন্ত্রাসী হয় ।বুঝতে না পারারই কথা।

সমাজ এক ধরনের জেলখানার মত একটি ব্যাপার। উপরতলার কিছু মানুষ সেখানে প্রভু হয়ে বসে আছে। সমাজে থাকতে গেলে তাদের কথা মানতে হয়। মাঝে মাঝে তাদের পা চেটে দিতে হয়। তাহলে বেশ ভাল থাকা যায়। এদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না। প্রতিবাদ করার ফলাফল ভয়াবহ।

আমরা বেশিরভাগ মানুষই এই জেলখানা মেনে নিয়েছি।আমরা হচ্ছি আমজনতা। উপরওয়ালাদের পা চেটে দিয়ে ভাল আছি। কিন্তু সবাই ওটা মানতে পারে না। পদলেহনকারী কুকুরের জীবন সবার পছন্দের নয়। এদের কাছে অস্তিত্ব রক্ষার চেয়ে মর্যাদা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এরা হয় মাথা উচুঁ করে বাচঁবে আর নয়ত বাঁচবেই না। এরাই মাঝে মাঝে প্রতিবাদের চেষ্টা করে। সমাজে প্রতিবাদীদের জন্য কোন জায়গা নেই। ভিন্নমতের পরিনতি নির্যাতন। উপরওয়ালাদের কথা না মানলে সন্ত্রাসী হতে হয়।

সমাজে বাঁচতে হলে কিছু হলেও টাকা পয়সা লাগে। কিন্তু সেই টাকা ঠিক কীভাবে উপার্জন করা হবে সমাজ তা স্পষ্ট করে বলে না। টাকা উপার্জন না করতে পারলে তুমি খাবার পাবে না কিন্তু টাকা কিভাবে উপার্জন করবে তা আমি জানি না - সমাজের মতটা এরকমই । উপরওয়ালারা আছেন ; তাদের পা চাটলে টাকা পাওয়া যায়। পা চাটতে রাজী না থাকলে টাকা পাবে না। পা চাটতে রাজী হলেও সবাই সে সুযোগ পায় না। পা চাটার সুযোগ পাবার জন্যই প্রচন্ড ভীড়। অসংখ্য মানুষ অপেক্ষায় আছে সেই সুযোগ পাবার জন্য।

এরকম অবস্থায় টাকা উপার্জনের আর একটাই পথ খোলা থাকে - তার নাম অস্ত্র। পা চাটতে না রাজী থাকলে অথবা পা চাটার সুযোগ না পেলে, না খেয়ে মরতে হবে। না খেয়ে মরতে কেউ রাজী নয়। মরার আগে অস্ত্র হাতে সে শেষ চেষ্টাটা করতে চায়। মরবই যখন তখন আর ভয় পাব কাকে? আইন না সমাজ? সন্ত্রাসী হচ্ছে সেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ যে পৃথিবীতে টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করছে। জন্মের পর থেকে সে দেখছে পৃথিবীর সব সম্পদ দখল করে বসে আছে একদল মানুষ। সেই সম্পদ কেউ এমনি এমনি দিয়ে দেবে না। তাকে জোর করে কেড়ে নিতে হবে। আইনকে তার ভয় পাবার কিছু নেই। কারন উপরওয়ালাদের লাথি খেয়ে, লজ্জায় অপমানে সে প্রতিদিন একটু একটু করে মরে। মৃত্যু তার জন্য নতুন কিছু নয় কারন তার জীবন মৃত্যুর চেয়েও দুর্বিষহ। 

একজন উশৃঙ্খল তরুনী একজন বিপ্লবী। উশৃঙ্খল হচ্ছে সে যে সমাজের প্রচলিত প্রথাগুলো মানে না। সেই সমাজ কোন সমাজ ? সেই সমাজ কিছু দিতে পারে না, পারে শুধু নিয়ম জারি করতে। সমাজের নিয়মে তাকে বিয়ে করতে হবে, সংসার করতে হবে। একটা মেয়ে নিজের মত করে বাঁচতে পারবে না। সে বাঁচবে পরিবারের কঠোর নিয়মের মধ্যে। যেন নিয়মই তার আজন্ম নিয়তি। তার পূর্বপুরুষদের তৈরী করা নিয়মই শেষ কথা। নিজের মনকে বাঁচাতে হলে তাকে সমাজের নিয়ম ভাঙতেই হবে। তাতেও বিপত্তি অনেক। সমাজ নিন্দা করে। তবুও সেই নিন্দার দায় মাথায় নিয়েও কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। সমাজ ছি ছি করে। আমি বলি বিপ্লবী। আর কিছু না হোক, অন্তত বেঁচে থাকার একটা অর্থ সে খুঁজে পেয়েছে।

জানি অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। সমাজের যারা সুবিধাভোগী তারা সমাজের নিয়মগুলো পছন্দ করে।এইসব সুবিধাভোগীদের ভাল থাকা নির্ভর করে সমাজের অস্তিত্বের উপর।মানুষ যদি নিয়ম ভাঙতে শুরু করে তাহলে এইসব সুবিধাভোগীদের কী হবে? নিয়ম ভাঙতে দেখলে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

তাই নিয়ম ভাঙার সাহস যাদের আছে, তাদেরকে আমার ভালো লাগে। সমাজের এই সমস্ত নিয়ম ভাঙা বিপ্লবীদের জন্য শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা।